চৌধুরী হারুনুর রশীদ,রাঙামাটি : আজ ২ ডিসেম্বর। দীর্ঘ দুই দশক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর ১৯৯৭ সালের এদিনে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষর হয়, যা পরবর্তীতে ‘পার্বত্য শান্তি চুক্তি’ নামে পরিচিতি পায়। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমার সঙ্গে এই চুক্তি সই হয়।সেই সময় ‘শান্তি বাহিনী’ তথা গেরিলা বাহিনীর নেতারা তাদের সব অস্ত্র সরকারের কাছে জমা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন। কিন্তু শান্তি প্রতিষ্ঠার চুক্তির ২ দশক বেশী সময় ধরে পাহাড়ে শান্ত হয়নি। খুন-খারাবি, অপহরণের পর হত্যা, আধিপত্য বিস্তার, এলাকা নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে দিনদিনই পাহাড়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির ভাষ্য, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন না হওয়ায় পাহাড়ে বিভিন্ন শ্রেণি একে পুঁজি করে পায়দা লুটছে। এর ফল হিসেবে দুই দশকে তৈরি হয়েছে আরও তিনটি আঞ্চলিক দল। যে কারণে এখনো সংঘাত।
পাহাড়ে আঞ্চলিক একটি ভেঙ্গে ৪ সংগঠন
১৯৯৭ সালে চুক্তি করার সময়েই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বিরোধিতা করেন তৎকালীন জেএসএসের ছাত্র সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সভাপতি প্রসিত খীসাসহ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা। পরবর্তীতে এই চুক্তি বিরোধিতা করে সন্তু লারমার সংগঠন থেকে বের হয়ে ১৯৯৮ সালে ২৬ জুন ঢাকায় এক কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রসিত খীসার নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) আত্মপ্রকাশ করে। ২০০১ সালে রাঙামাটি নানিয়ারচর উপজেলা থেকে তিন বিদেশি নাগরিককে অপহরণের মাধ্যমে ইউপিডিএফ তাদের সংগঠনের জানান দেয়। সেই থেকে শুরু পাহাড়ে, এলাকা নিয়ন্ত্রণ, আধিপত্য বিস্তার ও অপহরণের রাজনীতি। ক্রমন্নয়ে সবুজ পাহাড় হয়ে ওঠে অশান্ত। ভ্রাতৃঘাতি সংঘাতে প্রাণ হারায় কয়েক হাজার মানুষ।
চুক্তির ২৩ বছরেও ‘শান্তি ফেরেনি’
এদিকে ২০০৭ সালে ফের সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমতি (জেএসএস) মধ্যে অন্তঃকোন্দল দেখা দেয়। জেএসএস প্রভাবশালী নেতা সুধাসিন্দু খীসা, তাতিন্দ্র লাল চাকমা পেলেসহ একটি বিশাল গ্রুপ ২০০৭ সাল থেকে ২০১০ পর্যন্ত জেএসএসের কর্মকাণ্ড বিরোধী বিভিন্ন প্রচারণা চালায়। ২০১০ সালে আনুষ্ঠানিক ভাবে সুধাসিন্দু খীসা ও তাতিন্দ্র লাল চাকমা পেলের নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) ভেঙে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (এমএনলারমা) নামে নতুন আরেকটি সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে। শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের ১৩ বছরে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতি ভেঙে তিনটি সংগঠন সৃষ্টি হয়।
সর্বশেষ ২০১৭ সালে নভেম্বরে খাগড়াছড়ি জেলায় সাংবাদিক সম্মেলন করে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) ভেঙ্গে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) নামের নতুন সংগঠন আত্মপ্রকাশ। সর্বশেষ এই সংগঠন প্রসিত থীসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতা, অন্তঃকোন্দল ও নিজ দলের কর্মী হত্যার অভিযোগ তুলে ইউপিডিএফের সাবেক সশস্ত্র শাখার প্রধান তপন জ্যোতি চাকমা ও বর্মাকে আহ্বায়ক করে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) গঠিত হয়। এ নিয়ে পাহাড়ে শান্তি চুক্তির স্বাক্ষরের দুই দশকে জেএসএস ভেঙ্গে চার আঞ্চলিক দল গঠিত হয়।
তবে এক সময় খাগড়াছড়ি শহর দাপিয়ে বেড়ানো সংগঠন ইউপিডিএফের নেতাকর্মীরা রাজনৈতিকভাবে কোনঠাসা, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও গ্রেফতার আতংকে আত্মগোপনে রয়েছেন। অন্যদিকে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) নেতাদের অনেকেই আত্মগোপনে।
দুই জোটে বিভক্ত ৪টি আঞ্চলিক দল
বর্তমানে তিন পার্বত্য জেলায় চারটি আঞ্চলিক দলের আধিপত্য বিস্তার রয়েছে। কথিত আছে, চারটি আঞ্চলিক দল ২ জোটে বিভক্ত রয়েছে। এর মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি (শান্তি চুক্তি) সম্পাদনকারী সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) ও প্রসিত খীসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফ অলিখিত সমঝোতা করেছে। একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) ও প্রসিত খীসার ইউপিডিএফের সঙ্গে সমঝোতা হয়। যা একাদশ জাতীয় নির্বাচনে এক দলের হয়ে অন্য দলের নেতাকর্মীরা প্রচার-প্রচারণা দেখেই প্রমাণ মিলেছে। এতে করে এই দুইটি সংগঠন একে-অপরের সাথে ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত, হানাহানি বন্ধ রয়েছে।
১ ডিসেম্বর বুধবার পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের সভাপতি শাব্বির আহম্মদ সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য বলেন,পবিত্র সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক ও বৈষম্য মুলক ধারা গুলো সংশোধন করে চুক্তির পুন:মুল্যায়ন এবং চুক্তি বাস্তবায়নের শর্তানুযায়ী এ পর্যন্ত একটি ব্রিগেডসহ ২৩৮টি নিরাপক্তা বাহিনীর ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে । চুক্তির খ খন্ডের ৩৪ ধারা অনুয়ায়ী ইতিমধ্যে খাগড়াছড়ি জেলার ৩০টি বিভাগ.রাঙামাটি জেলা ৩০টি বিভাগ ও বান্দরবানে ২৮ বিভাগ হস্তান্তর করা হয়েছে। ঘ খন্ডের ১ ধারা অনুযায়ী ভারত প্রত্যাগত ১২ হাজার ২২৩টি উপজাতীয় শরনার্থী পরিবারকে প্রত্যাবাসন করা হয়েছে । প্রতিটি পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা নগদ অর্থ প্রদান করেছে সরকার। ২০ বছর পুর্বে যারা চাকরি ত্যাগ করেছিল তাদের চাকরিতে পুর্ন:বহাল করা হয়েছে। তাদের পুর্ণবাসন নিশ্চিত করার জন্য টাস্কফোর্স গঠন করা হয় ।প্রত্যাবাসিত শরণার্থীদের ভুমি সমস্যার সমাধান করে ভুমি বিরোধ নিস্পক্তি কমিশন গঠন করা হয়েছে । “খন্ডের ১নং ধারায় উভয়পক্ষ পার্বত্যচট্টগ্রাম অঞ্চলকে উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রায় অর্ধেকের বেশী বাঙ্গালী জনগোষ্টিকে অশ্বীকার করা হয়েছে। শিক্ষা,কর্মসংস্থান,অর্থনৈতিক কর্মকান্ড,সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সুবিধায় পাহাড়ে উপজাতিদেও নানা অগ্রাধিকার শর্তযুক্ত কওে বাঙ্গালীদেও প্রতি বৈষম্য করা হয়েছে। ভুমি ব্যবস্থাপনায় প্রথাগত রীতি অনুসারে বিধান যুক্ত করে বসবাসরত বাঙ্গালীরা ভুমিহীন ও বাস্তচ্যুত হবার আশংকা বৃদ্ধি পাচ্ছে ।
সংবাদ সম্মেলনে কয়েকটি সশস্ত্র গ্রুপ সন্ত্রাসী তৎপরতা চালাতে পাহাড়ে চাদাবাজির অভয়রন্য পরিণত করেছে। বছরে পাহাড়ে বিভিন্ন পেশার ওপর নিধারিত হারে ধায্য করে প্রায় ৪শ কোটি চাদা আদায় করে বলে জানায়। আঞ্চলিক সংগঠন গুলো ও তার সমর্থকেরা বাংলাদেশের মুল স্্েরাতধারা থেকে সর্বক্ষেত্রে বাড়তি সুযোগ সুবিধা দেয়া হয়েছে। এসব সুযোগ নিয়ে সংগঠনগুলো জাতীয় চেতনা,সার্বভৌমত্ব ,অখন্ডতা,উন্নয়নের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমুলক ও ঘৃনা ব্যাঞ্জক প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। তারা দেশী -বিদেশীর ইন্ধনে এনজিও পরামর্শে পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীন জুম্মল্যান্ড প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য কাজ করে যাচ্ছে জানায়। ভুমি কমিশনে আইনে -২০০১ এর অধিকতর সংশোধনী ২০১৬ জাতীয় সংসদের পাশ করা হয়েছে । শান্তি চুক্তি হচ্ছে পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার একটি আকাংক্ষা । কিন্ত সেই চুক্তি এমন কিছু ধারা সংযোজিত হয়েছে যা বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধান ও প্রচলিত বহু আইনের সাথে সাংঘর্ষিক ।
সেই সাথে বৈষম্যমুলক ও সাম্প্রদায়িক ?
চৌধুরী হারুনুর রশীদ রাঙামাটি।